আঞ্চলিক ভাষা
ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল বা ভূ-খন্ডে বসবাসরত মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আবার স্থানীয় রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ও পরিবেশগত কারণে এলাকাভেদে একই ভাষায় ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ, শব্দের অর্থ ও উচ্চারণগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বাংলা ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাভাষী জনগণের অঞ্চলভেদে বাকভঙ্গির কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কোন ভাষাকে আশ্রয় করে সীমিত পরিসরে ব্যবহৃত শব্দ বা বাক্যসমূহই আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে চিহ্নিত। ভাষাতাত্ত্বিকগণের কাছে আঞ্চলিক ভাষার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন: ভাষাতত্ত্বের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান আঞ্চলিক ভাষার সাহায্যে হতে পারে। আঞ্চলিক ভাষাকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সাহিত্যিক প্রভাবে সাহিত্যের ভাষা গড়ে ওঠে। আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যেই সাহিত্যিক ভাষার ইতিহাস বজায় থাকে।
ভাষাকে প্রাচীর দিয়ে সীমায়িত করা যায় না। এক জায়গায় ভাষা অনায়াসে অন্য জায়গার ভাষাকে প্রভাবিত করে। চুয়াডাঙ্গা এলাকার সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় রয়েছে উচ্চারণ সচেতনতা ও শব্দ প্রয়োগে ঔচিত্যবোধ। সেজন্য এ ভাষা প্রসাদগুণ সম্পন্ন ও সুষমামিন্ডিত। এ অঞ্চলের মুখের ভাষার গতি সাবলীল ও বিশিষ্ট বাগভঙ্গী খুবই জীবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী।
গত কয়েক শতাব্দী ধরে ভাগীরথী নদীর উভয় তীবরর্তী অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার ধ্বনি, রুপমূল, উচ্চারণ ও ব্যাকরগত কাঠামোর সৌসাম্য সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের উপর প্রভাব বিস্তার করে আসছে। এ অঞ্চলের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত কথ্য ভাষার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা চলিত ভাষা সমগ্র বাঙালি জাতির মৌখিক ভাষা হিসেবে মান্যতার সঙ্গে অনুসৃত হচ্ছে।
লোকসংস্কৃতির বাহন হচ্ছে লোকায়ত ভাষা। এ এলাকায় প্রচলিত ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন, ছড়া, মেয়েলী গীত, লোককাহিনী, বিংবদন্তী, লোকগাথা ও গীতিকার লালিত্যমন্ডিত বর্ণময় প্রকাশ সেই ভাষাতেই বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, চুয়াডাঙ্গা এলাকার গৌরবান্বিত এ উপভাষা চুয়াডাঙ্গা জেলার শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
চুয়ডাঙ্গা জেলঅর উপভাষা বিশিষ্টতা অর্জন করেছে তার ভৌগোলিক অবস্থানের ভাষাবিজ্ঞানী জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন , ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুকুমার সেন প্রমুখ পন্ডিতগণ মধ্যপূর্ব রাঢ়ী উপভাষার যে সীমানা নির্ধারণ করেছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা তার মধ্যে পড়ে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার মানুষ মোটামুটি শুদ্ধ বাংলা বাষায় কথা বলেন। এখানকার আঞ্চলিক বাষা তাই বাংলা ভাষারই অংশবিশেষ। তথাপি চুয়াডাঙ্গার কথ্য ভাষায় বাক্য ও উচ্চারণগত এমন কিছঝু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্যত্র দেখা যায় না। এখানে এমন কিছু শব্দ শোনা যায়, যা বাংলাভাষী আর কোন জায়গাতেই প্রচলিত নয়। এসব শব্দ ও কাব্য-সম্ভারই চুয়াডাঙ্গার আঞ্চলিক ভাষা, যা যুগ-যুগ ধরে এখানকার কথ্যভাষাকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে।
চুয়াডাঙ্গার আঞ্চলিক ভাষার বেশকিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। সেগুলো হলো: ও-কার এর বদলে উ-কার হয়ে যায়। যেমন: ঘোড়া/ঘুড়া, বোবা/বুবা, খোকা/খুকা, অতিরিক্ত সংযোজন লক্ষণীয়। যেমন: চাল/চাইল, ডাল/ডাইল, মূলা/মূইলো, কাঁচি/কাইচে ইত্যাদি। দ্রুত উচ্চারণের অক্ষর লোপ পায়। যেমন: করছিস/কচ্ছিস, মারছে/মাচ্ছে ইত্যাদি। চ অনেক ক্ষেত্রে ড হয়ে যায়। যেমন: ছেলেটা/ছেলেডা, ডালটা/ডালডা ইত্যাদি।
দ কে গ বলার প্রবণতা রয়েছে। যেমন: আমাদের/আমাগের, তাদের/তাগের, ইত্রঅদি। র কে অ উচ্চারণ লক্ষনীয়। যেমন: রাত/আত, রক্ত/অক্ত ইত্যাদি। দ্রুত উচ্চারণে ত লোপ পায়। যেমন: ভাত/ভা (মা ভা দাও)। ন উচ্চারিত হয় ল রুপে। যেমন: নিয়ে/লিয়ে, নড়াচড়া/লড়াচড়া ইত্যাদি।
এখানে আঞ্চলিক বাক্যের কিছু উদাহরণ ছাপা দেওয়া হলো:
বুকা (বোকা)-তুমার মত অগা মার্কা লোক তো দেকিনি। অপ্চো (অপচয়/বিনষ্ট)- এ্যাতো অপ্চো কি তার সৈজ্জ্য হয়! আশোইলে (জ্বালাতন)- একুন যা তো, আশোইলে করিস্নে। আস্পদ্দা (স্পর্ধা)- ছেইলেটার আস্পদ্দ তো কম না! আচাতিমি (অকারণ)-আচামিতি কি কেউ কারো গা’য় হাতে তোলে? আচিঘর (আতুরঘর)- খালেদা আচিঘর’তি (থেকে) একুনু বেরোয়নি। আগ্লা (খোলামেলা)- তাল্ডা আগ্লা রাকিছিস্, তাই মাছি বস্চে। আন্কুরা (নতুন)- আন্কুরা তবোন্ডা (লুঙ্গি) হারি’ফেলি? ইজের (পায়জামা)- নোতোন্ ইজেরডা ছিইড়ে গ্যালো।
ইবা, (এবার)- ইবার অসুক হোলি আর বাইচপো না। ইন্দুর (ইঁদুর)- ধানে খুব ইন্দুর লাইগোচ্ গো। উইদমো (বোকা প্রকৃতি)- উইদমো লোকের তালে পলাম দেক্চি। উমা (আশ্চর্যবোধক উচ্ছাস)- উমা!কী সুন্দর শাড়ি। ওমিন্দি (ঐদিক দিয়ে)-তোরে বুলাম ওমিন্দি যা, তুই গেলিনে।
কোইদমে (মিষ্টিকুমড়া)- কোইদমের ফলন গতবারই ভালো হোয়েলো। কোইতোর (কবুতর)- ওলির লাল কইতোরডা মইরে গিয়েচে। কের্মে কের্মে (ক্রমে ক্রমে)- জ্বরডা (জ্বরটা) কের্মে কের্মে বাইড়িই যাচ্চে। কুক্ড়ো (মুরগী)- কুকড়োগুইন খ্যাদ্যা শিগ্গির (মুরগীগুলো তাড়া শিগ্গির)। কুষ্টা (পাট)- বাজারে কুষ্টার দাম পোইড়ে গিয়েচে।
খাইদে (ময়লা/আবর্জনা)- খাইদেডা পরিস্কার কোলিনে? খ্যাতা (কাঁথা)- গত শতি খ্যাতার খুব কষ্ট হোয়েচে রে। খর (খয়ের)- বাজারতি দু’ট্যাকার খর্ আইনো (বাজার থেকে দুই টাকার খয়ের এনো)। খুশাম্দি/খুশান্দি/খুশামোদ (তোষামোদ)- ইস্কুলি যাওয়ার জন্নি উর্ ককুন্তি খুশান্দি কচ্চি ( স্কুলে যাওয়ার জন্য ওকে কখন থেকে তোষামোদ করছি)।
গেইড়ো (গেড়ো/আঞ্জলি)- গেইড়ো পাত শীগ্গীর, মুড়কি নে। গবোর (গোবর)- গবোর সারই ফসলে জন্নি ভালো। গিরাম/গৈগিরাম(পাড়াগাঁ)- গৈগিরামে একুন খুব অভাব। গোবিন (অন্তঃসত্বা; ছাগল-গরুর ক্ষেত্রে)-আহাগো জয়নালের গোবিন গরুডা (গরুটা) সাপে কাম্ড়ি মইরে গ্যালো! গড়ান্ (ঢালু)- রাস্তাডা এ্যাকেবারিই গড়ান্ হোয়েচে।
ঘষি/ঘুটা (গোবরে তৈরি জ্বালানি বিশেষ)- বৃষ্টির পানিতে ঘষিগুইন্ ভিইজে গ্যালো, শীগ্গীর তোল। ঘুন্নি (ঘুড়ি)-ঈদির আগে আকাশে অনেক ঘুন্নি ওড়ে। ঘ্যানা (বোকা/নির্জীব প্রকৃতির)- এ্যাতো ঘ্যানা লোক নিয়ে তো পারা যায় না দেক্চি।
চিরোন্ (চিরুনী)- চিরোন্ডা সেই যে হারাইলো, আইজও কিনার মুরোদ হলো আ। চাইলে পানি (চাল ধোয়া পানি)- চাইলে পানিডা গরুর নাইন্দে দি’দিস (চাল ধোয়া পানিটা গরুর নাদায় দিয়ে দেসি)। চশোমখোর (নির্লজ্জ)- চশোমখোরের মোতো কাজডা কি না কোলিই হৈতো না?
ছ্যান্ (গোসল)-ছ্যান্ডা কোইরে নিয়াই জানো ভালো ছিল (গোসলটা করে নেওয়াই যেন ভাল ছিল)। ছেউই (সেমাই)- ছেউই রান্দাডা আইজ্ এট্টু ভালো লাগিনি। ছাপড়ো (নিচু)- ঘর্ডা খু্বই ছাপ্ড়ো হৈলো।
সংস্কৃতি
অতি প্রাচীনকাল হতেই চুয়াডাঙ্গা অঞ্চল বাঙালী সংস্কৃতির সকল ঐতিহ্য লালন পালন করে আসছে। দেশের লোকসাহিত্য ও লোকসংগীতে এ জেলার একটি বিশেষ অবস্থান রয়েছে।বিশেষ করে এ জেলার সমৃদ্ধ বাউল সংগীতের খ্যতি দেশ ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রখ্যাত লালন সাধক খোদা বকশ সাঁই এর জন্মস্থান এ জেলার জাঁহাপুর গ্রামে, যিনি লোকসংগীতে তাঁর বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন।বাউল ছাড়াও যাত্রাগান, জারিগান, কবি গান, বিয়ে উপলক্ষে মেয়েলি গান, পুতুল নাচ, ঝাপান গান (সাপের খেলা) এ জেলার সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে। |
| |
এ জেলায় বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। যার মধ্যে ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী গড়াইটুপিঅমরাবতী মেলা অন্যতম। প্রতি বছর আষাঢ়ের ৭ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত এইঐতিহাসিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও সরিষাডাঙ্গার বিশুশাহ বাউল মেলা, খোদা বকশ সাঁই-এরমৃত্যুদিবস উপলক্ষে জাহাপুরে দু্ই দিনের বাউল মেলা অন্যতম।এ ছাড়াও প্রতি বছর ১লা বৈশাখে জেলা শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। |
| |
এ জেলার মানুষ ঐতিহ্যগত ভাবে সংস্কৃতিমনা বলেই এখানে গড়ে উঠেছে অনেক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও নাট্য ক্লাব। ১৯৫০ সালে চুয়াডাঙ্গায় ডাঃ মনোরঞ্জন ব্যানার্জির উদ্যোগে প্রথম সংগীত প্রতিষ্ঠান “চুয়াডাঙ্গা সংগীত সংঘ”প্রতিষ্ঠিত হয়।১৯৭৭ সালে “চুয়াডাঙ্গা মহকুমা শিল্পকলা পরিষদ”নামে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর স্থানীয় শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় যা পরবর্তীতে শিল্পকলা একাডেমীর মর্যাদা লাভ করে।এছাড়াও অরিন্দম সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংলাপ সাংস্কৃতিকগোষ্ঠী, চুয়াডাঙ্গা থিয়েটার,অনির্বান থিয়েটার, সাম্প্রতিক থিয়েটার, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, সরগম শিল্পি গোষ্ঠী, আলমডাঙ্গা কলা কেন্দ্র, আলমডাঙ্গা শিল্পকলা একাডেমী, নাগরিক নাট্য দল,স্বদেশ শিল্পি গোষ্ঠী, মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, দোলনচাপাঁ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, হিন্দোল, ভৈরবী, ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম, লালন একাডেমী ইত্যাদি অনেক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সংস্কৃতি অঙ্গনে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। |
| |
এ জেলার মানুষের বিনোদনের জন্য গড়ে উঠেছে বেশ কিছু সিনেমা হল। যার মধ্যে রুপছায়া সিনেমা, নান্টুরাজ সিনেমা, আলমডাঙ্গার আলমডাঙ্গাটকীজ, শিলা সিনেমা, দর্শনার হীরা সিনেমা, জীবননগরের মহানগর ও আধুনিক সিনেমা অন্যতম। এ ছাড়াও এ জেলায় শিশুদের বিনোদনের জন্য গড়ে উঠেছে শিশু স্বর্গ ও পুলিশ পার্ক। |
|
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস