লোকসঙ্গীত ও ঐতিহ্য
অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলা ছিল বাঙালী সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। পৌরবময় সেই উত্তরাধিকার চুয়াডাঙ্গা জেলাও বহন করে চলেছে। এখানকার লোকসংস্কৃতি ও গ্রামীণ ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। এক সময় মুর্শিদী, মারফতি, যাত্রা, ভাসান, কবিগান, কীর্তন, জারি গান, গাজারী গীত, গাজনের গান, মাদার পীরের গান, মেয়েলী গীত, বিয়ের গান, কৃষকের মেঠোগান, প্রভৃতি গ্রামগুলো মুখরিত করে রাখত।
এ জেলা মুসলমান ফকির ও বাউলপন্থী হিন্দু বৈষ্ণব প্রমুখের ধর্ম সাধনার একটি কেন্দ্রস্থল। লালনের বহুসংখ্যক অনুসারী ও গোসাই গোপাল ও অপরাপর অনেক বাউলপন্থী রসিক বৈষ্ণবের বাস ও বিচরণ স্থান এই চুয়াডাঙ্গা।
জারিগান :
জারিগান বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি বিশিষ্ট সম্পদ। বাউল গানের পাশাপাশি এ অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে জারিগান বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মহররমের চাঁদ দেখার রাত থেকে জারিগান ও জারিনৃত্য শুরু হয়।১০ মহররম পর্যন্ত ১০ দিন ধরে এই গান অনুষ্ঠিত হয।
চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে জারিগানের কুশলী শিল্পী হিসেবে আহাদ গায়েন (কুলচারা), শুকুর আলী (হানুরবাড়াদি), আজিবার রহমান (সুমিরদিয়া), সুলতান আলী ও ফলেহার (হাজরাহাটি), মাতু গায়েন (হোগলবগাদি), হায়দার আলী (জাফরপুর), হোসেন গায়েন (নাগদহ), মোহর আলী, নবীন মন্ডল প্রমুখের অবদান রয়েছে।
ভাসানগান :
চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে শ্রাবণ মাসে অর্থাৎ বর্ষা ঋতুর প্রায় মাঝামাঝি সময়ে এই ভাসানযাত্রার প্রচলন রয়েছে। বর্ষাকালেই এদেশে সাপের কামড়ে লোকের মৃত্যু হয় বেশি। বাংলার লৌকিক কাহিনী চাঁদ সদাগর এবং তার পুত্রবধু বেহুলা, পুত্র লখীন্দর ও মনসার কাহিনীকে অবলম্বন করে ভাসানযাত্রা রচিত।
ভাসানযাত্রার ওলিয়ার রহমান মালিতা, তকিম মন্ডল, কিয়ামুদ্দিন (জাফরপুর), হাজারী (দৌলতদিয়াড়) সৈয়দ আলী (পীরপুর), আফসার আলী, বাহার আলী, মাদব, ভাদু, কায়েম আলী, মনসুর চাঁদ, তাহার আলী (চুয়াডাঙ্গা) প্রমুখ অবদান রয়েছে।
ঝাপন ও মনসার গান :
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি ঝাপান অনুষ্ঠিত হয়। সাপসহ সাপুড়েরা অন্যান্য সাপুড়েদের সাথে প্রতিযোগিতামূলক ঝাপানে অংশ নিয়ে থাকে। চুয়াডাঙ্গা জেলার কেদারগঞ্জের প্রেমচাঁদের গলায় সেই চির পুরাতন অথচ চির নবীন বেহুলা লখীন্দরের খাত
এই না শাওন মাসে ঘনবৃষ্টি পড়ে,
কেমন করে থাকবো বলো আমি
অন্ধকার ঘরে।
যাত্রা :
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির সমৃদ্ধ ভান্ডারে যাত্রা এক অমূল্য সম্পদ। ঐতিহ্যমন্ডিত কোন লোকবিষয়ক নাট্যরূপ দিয়ে তার যে গীতাভিনয় প্রদর্শন করা হয় তাকেই যাত্রা বলা হয়। চুয়াডাঙ্গাতে বেশ কয়েকটি যাত্রা দল আছে যেমন- শক্তিমিলন অপেরা (চুয়াডাঙ্গা), রংমহল অপেরা (জামজামি), সরোজগঞ্জ যাত্রা ইউনিট (তিতুদহ), পল্লীশ্রী অপেরা (আসমানখালী), হিরোবয়েজ যাত্রা গোষ্ঠী (লক্ষ্মীপুর), গাড়াবাড়িয়া যাত্রা ইউনিট ইত্যাদি যথেষ্ট যশ ও খ্যাতি লাভ করেছিল।
কবিগান :
কবিগান চুয়াডাঙ্গা জেলার অন্যতম জনপ্রিয় গান। আগে শীতকালব্যাপী কবিগানের লড়াই হতো। অনেক সময় ৬/৭ দিন ধরেও প্রতিযোগিতামূলকভাবে এই গান চলতো। কাতর বয়াতি (চুয়াডাঙ্গা), আব্দুর রাজ্জাক (এনায়েতপুর, বাড়াদি), হোসেন গায়েন (নাগদাহ), মাহতাব গায়েন (ভোগাইলবগাদি), আহাদ গায়েন (কুলচারা), সারোয়ার গায়েন (খাদিমপুর) প্রমুখ কবিয়াল হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন।
গাজীর গান :
লৌকিক আচারসহ গাজীর গান পরিবেশিত হতো। গাজী পীরের বন্দনা ও মাহাত্ম্য প্রচারই গাজীর গানের উদ্দেশ্যে। সন্তান লাভ, রোগ-ব্যধির উপসম, অধিক ফসল উৎপাদন, গরু-বাছুর ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি এরুপ মনস্কামনা পুরণার্থে গাজীর গানের পালা দেওয়া হতো।
গাজনের গান :
লোক উৎসবমূলক গাজনের গান চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের নিম্নবর্ণের হিন্দু সমাজে প্রচলিত ছিল। এখানো চৈত্র সংক্রান্তিতে তিনদিনব্যাপী গাজন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
মেয়েলী গীত :
চুয়াডাঙ্গা মেয়েলী গীত বেশ সমৃদ্ধ। যেকোন পারিবারিক ও সামাজিক আমোদ উৎসবে বা আচার-অনুষ্ঠানে গ্রামের মেয়েরা একক বা দলবদ্ধভাবে এ গান পরিবেশন করে থাকে।
এছাড়াও লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে চুয়াডাঙ্গা এলাকায় যেসব শিল্পী কুশলীরা বিভিন্ন সময় অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে দৌলতদিযাড়ের হাজারী বাদল, নতিডাঙ্গার দিদার বকস, খাদেমপুরের সাবের গায়েন, মোজাম্মেল ও দিদার বকস প্রমুখ।
শব্দগান এর শিল্পীদের মধ্যে জাহাপুরের খোদা বকস শাহ ও ইউনুস আলী, ভুলটিয়ার খোরশেদ শাহ, তাইজেল ও আফজাল শাহ, বহালগাছির হেদায়েত শাহ, দর্শনার হোসেন শাহ, ফরিদপুর (আলমডাঙ্গা) এর বেহাল শাহ ও দুলাল শাহ প্রমূখ।
চুয়াডাঙ্গা জেলার লোকজ উৎসব
চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের কৃষক সমাজে আনন্দঘন পরিবেশে নানারকম উৎসব পালিত হতো। বিশেষ করে বীজ বোনা ও ফসল কাটা কাজ শেষ হলে সম্পন্ন কৃষকের ঘরে আনন্দ উৎসবের আয়োজন ছিল অতীতের সাধারণ ঘটনা। নানারকম নাচ-গান আনন্দস্ফুর্তির মধ্যে দিয়ে পল্লী পরিবেশকে আনন্দমুখর করে তোলা হতো।
গাস্বি উৎসব :
আশ্বিন মাসের শেষ রাত থেকে এ অনুষ্ঠানের শুরু, শেষ হয় পয়লা কার্তিকের সকালে। ফসল যাতে ভালো হয়, সে উদ্দেশ্যে হয় এই উৎসব। জনশ্রুতি আছে;
আশ্বিনে রাঁধে বাড়ে,
কার্তিকে খায়,
যে যেই বর মাগে
সেই বর পায়
নবান্ন :
নতুন ফসল ঘরে উঠলে অগ্রহায়ণ মাসে ধুমধামের সাথে চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে নবান্ন উৎসব পালিত হয়। ঢেঁকিতে নতুন চাল কুটে, পিঠে পুলি, নারকোলের নাড়ু বানিয়ে পাড়া প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজনের সাথে খাওয়া দাওয়া হতো।
বৃষ্টি আবাহন :
যথাসময়ে বৃষ্টি না হলে কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে বিপর্যয় দেখা দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য চুয়াডাঙ্গা এলাকায় ব্যাঙ বিয়ে, বদনা বিয়ে ইত্যাদি অনুষ্ঠান হয়।
হালখাতা :
হালখাতা প্রধানত ব্যবসায়ীদের উৎসব। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে চুয়াডাঙ্গা এলাকার ব্যবসায়ীরা হিসাবের নতুন খাতা খোলে এবং তাদের ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করে।
পয়লা বৈশাখ :
বৈশাখের প্রথম দিন আলু ভর্তা, ডালভর্তা, মাছভাজা দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার রেওয়াজ দেখা যায়। এই দিন সবাই সাধ্যমতো ভাল খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে । এতে এই বিশ্বাস কাজ করে যে, বছরের প্রথম দিন ভালো খাওয়া দাওয়া হলে সারা বছরই ভালো খাওয়া হবে।
মেলা :
পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ডিঙ্গেদহসহ চুয়াডাঙ্গা গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারে প্রায় অর্ধশতাধিক মেলা বসে। এসব মেলায় বিভিন্ন রকম জিনিসপত্র নানারকম খেলনা আর প্রচুর মিষ্টান্ন বিক্রি হয় এবং প্রচন্ড লোক সমাগম ঘটে। এছাড়া ১লা আষাঢ় থেকে ৭ দিন গড়াইটুপির মেটেরি মেলা, বারুনী এবং গঙ্গাপুজা উপলক্ষে নানা জায়গায় জমজমাট মেলা বসে। গড়াইটুপি মেলায় বাংলাদেশের বহু জেলার লোক মেলায় আগমন ঘটে।
পুতুল নাচ:
চুয়াডাঙ্গা জেলায় এক সমযে পুতুল নাচ জনপ্রিয় ছিল। আন্দুলবাড়িয়া ও মুর্তজাপুর অঞ্চলে কয়েকটি পুতুল নাচের দল ছিল। এরা মাটি, কাঠ ও কাপড় দিয়ে তৈরী পুতুল নাচিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। পর্দার আড়ালে সুতোর সাহায্যে পুতুলকে নাচানো হতো। পৌরাণিক কাহিনী ছিল এ নাচের বিষয়।
হিজড়া নাচ :
চুয়াডাঙ্গার হিজড়া সম্প্রদায় তাদের জীবিকার পন্থা হিসেবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নবজাত শিশুকে কোলে নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচ গান বাজনা পরিবেশন করে টাকা-পয়সা, চাল আদায় করে থাকে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস